রবিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৯

রোম সম্রাট হেরাকল ও আবু সূফিয়ানের মধ্যকার কথোপকথন

আবূ সুফিয়ান বলেন, সর্বপ্রথম তিনি আমাকে যে  যে প্রশ্ন করেন তা হল : হেরাকল : আপনাদের মধ্যে ঐ লোকটির জন্ম কিরুপ বংশে ? আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম, তিনি আমাদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মগ্রহন করেছেন । হেরাকল : আপনাদের মধ্যে তাঁর পূর্বে অন্য কেউ এরুপ নবূওয়তের দাবী করেছেন কি না? আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম, না (ইতিপূর্বে আর কেউ নবুওয়তের দাবী করেনি)। হেরাকল : তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ রাজা -বাদশাহ ছিলেন কি না? আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম না । হেরাকল : তাঁর অনুসারীদের মধ্যে ধনাঢ়্য ব্যক্তিগণ বেশি না গরীব জনসাধারণ? আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম : গরীব জনসাধারণ ।
হেরাকল : তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে?  আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম, দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে । হেরাকল : কেউ তাঁর ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর এ ধর্মের দোষত্রুটি দেখে পরিত্যাগ করে কি না? আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম না। হেরাকল : এ লোকটি বতর্মানে যা বলছে, আপনারা কি তার পূর্বে কখনো তার প্রতি মিথ্যাবাদিতার অভিযোগ করেছেন? আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম না। হেরাকল : তিনি কি ইতিপূর্বে কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন? আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম, না। তবে সম্প্রতি আমরা তাঁর সাথে একটি সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। জানি না তিনি এ ব্যাপারে কি করেন। আবূ সুফিয়ান বলেন, এ প্রসঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে এর বেশি বলার সাহস আমার ছিল না। হেরাকল : আপনারা কি তাঁর সাথে কোন যুদ্ধ করেছেন?  আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম, হ্যাঁ। হেরাকল : তাঁর সাথে আপনাদের যুদ্ধের ফলাফল কি হয়েছে? আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম, যুদ্ধের ফলাফল আমাদের মধ্যে ঘূর্ণায়মান, কখনো তিনি বিজয়ী হয়েছেন আবার কখনো আমরা বিজয়ী হয়েছি। হেরাকল : তিনি আপনাদের কি কি কাজের আদেশ করে থাকেন? আবূ সুফিয়ান : আমি বললাম, তিনি আমাদের আদেশ করেন এক আল্লাহর ইবাদত কর, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না, তোমাদের পূর্বপুরুষদের কুসংস্কার ছেড়ে দাও। তিনি আমাদের আরো আদেশ করে থাকেন, নামাজ কায়েম কর, সত্যবাদী হও, অন্যায় থেকে বিরত থাকো, আত্মীয়তার হক আদায় কর ইত্যাদি । অতঃপর সম্রাট তার প্রতিটি প্রশ্নের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে দোভাষীকে বললেন, আপনি আবূ সুফিয়ানকে বলুন - আমি আপনাকে নবুওয়তের দাবীদার ব্যক্তির বংশ মর্যাদা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তরে আপনি বলেছেন, তিনি আপনাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশোদ্ভূত। নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলগণ এমনিভাবে সম্ভ্রান্ত বংশেই জন্মগ্রহন করে থাকেন। হেরাকল : আমি আপনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনাদের মধ্যে ইতিপূর্বে আর কেউ এরুপ কথা বলেছে কিনা? আপনি বলেছেন, না। সুতরাং আমি বলছি, যদি ইতিপূর্বে কেউ এ ধরনের কথা বলত, তা হলে আমি বলতাম, তিনি তার পূর্বসূরি ব্যক্তির কথাই বলছেন। হেরাকল : আমি আপনাকে আরো প্রশ্ন করেছিলাম, তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ রাজা বাদশাহ ছিলেন কি- না? উত্তরে আপনি না বলেছেন। যদি তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ রাজা বাদশাহ থাকত, তা -হলে আমি বলতাম, তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি তাঁর পূর্বপুরুষদের মধ্যে রাজত্ব তালাশ করছেন। হেরাকল : আমি আপনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, বতর্মানে তিনি যা বলছেন ইতিপূর্বে আপনারা কি কখনো তাঁর উপর মিথ্যাবাদীতার অভিযোগ করেছেন? আপনি উত্তর দিয়েছেন, "না" তাই আমি বিশ্বাস করি, তিনি যখন মানুষের মধ্যে মিথ্যাচারিতার অভিযোগ থেকে মুক্ত, তখন আল্লাহ সম্পর্কে কখনো মিথ্যা বলতে পারেন না। হেরাকল : আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সম্মানিত ধনাঢ্য ব্যক্তিগন না গরীব জনসাধারণ তাঁর অনুসারী হয়ে থাকেন? আপনি উত্তরে বলেছেন, গরীব জনসাধারণই বেশি বেশি তাঁর অনুসারী হয়ে থাকেন। মূলত : গরীব জনসাধারণই নবী রাসূলগনের বেশি অনুসারী হয়ে থাকেন। হেরাকল : আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে। আপনি উত্তরে বলেছেন, দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। নিশ্চয়ই ঈমানের কাজ পরিপূর্ণ হওয়া পযর্ন্ত এরূপই হয়ে থাকে। হেরাকল : আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর ধর্মে দিক্ষিত হওয়ার পর নাখোশ হয়ে কেউ ধর্মান্তরিত হয়েছে কি না? উত্তরে আপনি বলেছেন "না"। প্রকৃতপক্ষে ঈমান এরুপই হয়ে থাকে (যখন অন্তরের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় )। হেরাকল : আমি আপনাকে তার সম্পর্কে  জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন কি-না? আপনি বলেছেন "না"। প্রকৃতপক্ষে রাসূলগণ এরূপই হয়ে থাকেন। তাঁরা কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না। হেরাকল : আমি আপনাকে আরো প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি আপনাদেরকে কিরূপ কাজের আদেশ করে থাকেন। উত্তরে আপনি বলেছেন, তিনি আপনাদেরকে আদেশ করে থাকেন, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। তিনি মূতিপূজা করতে নিষেধ করেন। তিনি আপনাদের আরো আদেশ করেছেন নামাজ কায়েম, সত্যবাদিতা অবলম্বন এবং সকল অন্যায় থেকে বিরত থাকার জন্য। আপনি যা বললেন, যদি তা সত্য হয়ে থাকে তা হলে আমি বলছি, তিনি অচিরেই আমার পদতলের এ স্থানেরও মালিক হবেন। আমি অবশ্য জানতাম, তিনি অচিরেই আবির্ভূত হবেন। তবে আমার এরূপ ধারণা ছিল না যে, আমি যদি জানতাম, আমি তাঁর কাছে পৌছতে সক্ষম হব, তা হলে অবশ্যই তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করার চেষ্টা করতাম। আর যদি আমি তাঁর সাক্ষাতে ধন্য হতাম তা হলে তাঁর পদযুগল ধৌত করে দিতাম। অতঃপর সম্রাট হেরাকল রাসূলুল্লাহ (সঃ) -এর দেয়া পত্রখানা আনালেন, যা তিনি হযরত দাহইয়া কলবী (রাঃ) -এর মাধ্যমে বসরার শাসনকর্তার নিকট প্রেরণ করেছিলেন। অতঃপর বসরার শাসনকর্তা উক্ত পত্রখানা সম্রাট হেরাকলের কাছে প্রদান করেন। সম্রাট উক্ত পত্রখানা পাঠ করেন।
রাসূল (সঃ) -এর পত্রের বঙ্গানুবাদ : বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। পরম দাতা দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। এ পত্র আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল মুহাম্মদ (সঃ) -এর পক্ষ হতে রোম সম্রাট হেরাকল -এর প্রতি - যে হেদায়েতের অনুসরণ করবে তার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি আপনাকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। যদি ইসলাম গ্রহণ করেন তা হলে নিরাপদে থাকবেন। এর পুরস্কার স্বরুপ আল্লাহ আপনাকে দ্বীগূন প্রতিদান দিবেন। আর যদি আপনি ইসলাম হতে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন, ত হলে প্রজাদের সকলের অপরাধও আপনার উপর অর্পিত হবে। অর্থাৎ, আপনি সকলের পাপের ভাগী হবেন।
পত্রে আরো লেখা ছিল : হে আহলে কিতাব ! তোমরা সব কিছু ছেড়ে এমন এক কালেমার দিকে ত্ত্বরা করে আস যা তোমাদের ও আমাদের মাঝে সমান।
"আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পূজা করো না। তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করো না। আর এক আল্লাহ ছাড়া আমাদের কেউ পরস্পর পরস্পরকে প্রভূ বলে গ্রহণ করবে না। যদি তোমরা এটা গ্রহণ না কর, তা হলে তোমরা তাদেরকে বলে দাও, তোমরা এ কথার উপর সাক্ষী থেকো যে, আমরা আল্লাহর অনুগত ।"
পত্র পাঠের প্রতিক্রিয়া : আবূ সুফিয়ান বলেন, সম্রাট হেরাকল তখন যা বলার বললেন এবং পত্র পাঠ থেকে অবসর হলেন। তখন উপস্থিত সভাসদবৃন্দের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেল। লোকদের কথাবার্তার আওয়াজ বড় হয়ে গেল। আমাদেরকে তখন তার মজলিস হতে বের করে দেয়া হল।বের করে দেয়ার পর আমি আমার সাথীদেরকে বললাম, "আবূ কাবশার " ঘটনা তো অনেক বেড়ে গেছে। স্বয়ং রোম সম্রাট পর্যন্ত তাকে ভয় করছেন (আবূ কাবশা হযরত হালিমা সাদিয়ার স্বামীর উপনাম। এস্থলে হুজুর (সঃ) -কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে )। আবূ সুফিয়ান বলেন, এ ঘটনার পর থেকে আমার অন্তরে এরূপ বিশ্বাস জন্মেছিল যে, অবশ্যই রাসূল (সঃ) বিজয়ী হবেন। এমন কি আল্লাহ তা'আলা আমার অন্তরে ইসলামের মহাব্বত ঢুকিয়ে দিলেন।
সম্রাটের স্বপ্ন : ইবনে নাতুর - যিনি বায়তুল মাকদাসের শাসনকর্তা ছিলেন, সম্রাট হেরাকল -এর বন্ধুও বটে, তিনি মুলকে শামে নাসারাদের সর্দারও ছিলেন। তিনি বর্ণনা করেন, এক সময় সম্রাট হেরাকল যখন 'ইলিয়া' (বায়তুল মাকদাস ) আগমন করলেন, তখন একদিন প্রত্যূষে তিনি খুবই তীক্ষ্ণ মেজাজ এবং পেরেশান অবস্থায় উঠলেন। এক সাথী তাঁকে বললেন, হে সম্রাট ! আজ আমরা আপনাকে খুব পেরেশান অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি, কারণ কি?
ইবনে নাতুর বলেন, সম্রাট হেরাকল একজন গনকও ছিলেন। তারকাসমূহের দিকে তিনি সর্বদা দৃষ্টি রাখতেন। উত্তরে সম্রাট বললেন, আমি আজ রাতে যখন তারকাসমূহের দিকে তাকালাম তখন দেখতে পেলাম, খাতনাকারীদের বাদশাহ জয়যুক্ত হয়েছেন। তোমরা বল তো, এ যমানায় কারা খাতনা করে থাকে? উত্তরে তার সাথীগন বললেন, বতর্মান যমানায় ইহুদিগনই তো খতনা করে থাকে। সূতরাং তাদের ব্যাপারে পেরেশান হওয়ার কিছু নেই। বরং আপনি আপনার এলাকার সকল শহরে এ ফরমান পাঠিয়ে দিন যেখানে খতনাকারী ইহুদিরা বসবাস করছে, লোকেরা যেন তাদের সবাইকে হত্যা করে। যখন সম্রাট অমাত্যদের সাথে এরূপ আলাপ আলোচনায় রত ছিলেন, ঠিক এ সময় এক ব্যক্তিকে সম্রাট হেরাকলের কাছে নিয়ে আসা হল, যাকে গাসসানের শাসনকর্তা সম্রাটের কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি রাসূল (সঃ) -এর অবস্থা ও খবরাখবর বর্ণনা করতেন। সম্রাট যখন তার খবরাখবর নিলেন, তখন তিনি আদেশ করলেন, তাকে গোপন জায়গায় নিয়ে যাও এবং দেখ তার খতনা হয়েছে কি-না? অতঃপর লোকেরা তাকে পরীক্ষা নিরিক্ষা -করার পর বলল, হ্যাঁ তার খতনা করা হয়েছে। তারপর তাকে আরবদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে বলল, আরবরা খতনা করে থাকে। তখন সম্রাট হেরাকল বললেন, ঐ ব্যক্তিই হল এ
দলের বাদশাহ, যিনি বতর্মানে আর্বিভূত হয়েছেন। অতঃপর সম্রাট হেরাকল এ ঘটনা তার এক বন্ধুর কাছে লিখে পাঠান, যিনি জ্ঞান -বিজ্ঞানে তার সমকক্ষ ছিলেন। তারপর সম্রাট 'হেমসে ' চলে গেলেন। হেমসে থাকা অবস্থায় তার বন্ধুর পক্ষ হতে পত্রের জবাব এসে পৌঁছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) -এর আর্বিভাব সম্পর্কে সম্রাট হেরাকলের যে ধারনা ছিল, তার বন্ধুর অভিমতেও তদ্রূপই ব্যক্ত করা হল যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে নবী হিসেবেই প্রেরিত হয়েছেন।

সহীহ বোখারী শরীফ,  ১ম খণ্ড হাদীস নং (0৬)

























































































































































































































































































































কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

বাংলা ওয়াজ, আল-কোরআনের আলোচনা, ওয়াজ,

হযরত ওমর (রাঃ) -এর দ্বীনী মর্যাদা নিয়ে রাসূল (সঃ) একি বললেন ? ।

হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্ললাহ (সঃ) ইরশাদ করেছেন, এক সময় আমি নিদ্রামগ্ন ছিলাম । স্বপ্নযোগে দেখতে পেলাম, লোকদেরকে আমার সম্মু...

আল-কোরআন, আল-হাদীস,